Kjkhan : করোনা ভাইরাসের অধিক সংক্রমণ এলাকাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোনভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। গতকাল সোমবার সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ তথ্য জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভপতিত্বে মন্ত্রিসভার এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। করোনা সংক্রমণ মাত্রা বাড়ার মধ্যে রেড, ইয়োলো ও গ্রিন জোন করে এলাকাভিত্তিক লকডাউনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আজ মঙ্গলবার রাত ১২টার পর থেকে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকা লকডাউন করা হবে ।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার তিন মাসের মাথায় ৮ জুন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৬৮ হাজার ৫০৪ জন। আর মোট মৃত্যু হয়েছে ৯৩০ জনের। সুস্থ হয়েছেন ১৪ হাজার ৫৬০ জন। এ অবস্থায় জোনিং করে লকডাউনের বিষয়ে মন্ত্রিসভায় কোনো আলোচনা হয়েছে কি-না, প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটা কেবিনেট মিটিংয়ে আলোচনা হয়নি, মন্ত্রী (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) মহোদয়ের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কোনো এলাকায় যদি অধিক সংক্রমণ থাকে সেই এলাকাকে যদি স্পেশালি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন গতকালকেই। সেটা এডমিনিস্ট্রিটিভ ওয়েতে করে ফেলতে পারবে। আমাদের যে সংক্রামক ব্যাধি আইন আছে, এটা সেই আইনের মধ্যে দেওয়া আছে। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অথরাইজড। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী এটা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছেন যে, আইটি ব্যবহার করে যেভাবে আইসিটি বিভাগ জোনিং করার চিন্তা-ভাবনা করছে, এটা সারা পৃথিবীতে করা হচ্ছে। এটাতে সুবিধা আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য এঙ্িিকউটিভ মিনিস্ট্রি তারা বসেই যদি মনে করে কোনো জায়গাটাকে রেড জোন ডিক্লেয়ার করা সবার জন্যই ভালো, কারণ সবাই তখন সতর্ক হতে পারবেন।
আজ মঙ্গলবার রাত ১২টার পর থেকে পূর্ব রাজাবাজার লকডাউন: আজ মঙ্গলবার রাত ১২টার পর থেকে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকা লকডাউন করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। গতকাল সোমবার দুপুর একটায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলার লক্ষ্যে ডিএনসিসি এলাকার জন্য গঠিত কমিটির এক অনলাইন সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এর আগে লকডাউন প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। কোন ওয়ার্ডকে কীভাবে লকডাউন করতে হবে তা নিয়ে এরই মধ্যে আমি আমাদের কাউন্সিলর, কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের যে কনফারেন্স হয়েছে, সেখানেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তিনি জানান, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে অনেকদিন সাধারণ ছুটি রেখেছিল সরকার। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। জীবাণুটি ঠিকই সারাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকাকে রেড (লাল) কিংবা ইয়েলো (হলুদ) জোন নির্ধারণ করে লকডাউনে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
স্বাস্থ্যবিভাগ জানিয়েছে, কোনও এলাকায় প্রতি এক লাখ বাসিন্দার মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৩০-৪০ জন হলে সেই এলাকা রেড জোন হিসেবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে। প্রতিটি এলাকা ম্যাপিং করে লকডাউন করা হবে। এটি পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হবে। এটি সফল হলে পরের সপ্তাহ থেকে সামগ্রিক পরিকল্পনা করে মাঠে নেমে পড়বেন সংশ্লিষ্টরা।
জোন ভাগ হবে যেভাবে: কোনও এলাকার বাসিন্দাদের প্রতি লাখে অন্তত ৩০-৪০ জন করোনা আক্রান্ত হলেই রেড জোন ঘোষণা করা হবে। রোগীর সংখ্যা এর কম থাকলে তা ইয়েলো জোন হিসেবে বিবেচিত হবে। দীর্ঘমেয়াদে ইয়েলো জোনকেও লকডাউনের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে কিছুটা শিথিল অবস্থা থাকবে। প্রয়োজনে কাগজ দেখিয়ে ইয়েলো জোন এলাকা থেকে বের হওয়া যাবে। জোন ভাগের ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্তদের ফোন নম্বরের অবস্থান বিশেষ কাজে আসবে। সেই নম্বরের অবস্থান নির্ধারণ করে কোন এলাকায় কত রোগী তা সুনির্দিষ্টভাবে জানার কাজ করছে আইসিটি বিভাগ। তবে তা এখনও শেষ হয়নি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেলে এ সপ্তাহেই উদ্যোগটি কার্যকর করা যাবে বলে আশাবাদী স্বাস্থ্যবিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান।
জীবনযাপন হবে যেভাবে: সাধারণ ছুটির সময় দেখা গেছে, ঘর থেকে বের হতে বিভিন্নভাবে নিরুৎসাহিত করা হলেও কেনাকাটার জন্য বাইরে এসেছে মানুষ। ঘর থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে শপিং করার পরামর্শ দেওয়া হলেও তা মেনে চলেননি অনেকে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, কোনও এলাকায় কঠোর লকডাউন ঘোষণা করলে সেখানকার দৈনন্দিন জীবনযাপন কীভাবে হবে। লকডাউন থাকা এলাকার জনসাধারণের প্রবেশ ও বহির্গমন বন্ধ থাকবে। এক্ষেত্রে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য লকডাউন এলাকার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়া হবে। ভ্যানে করে এলাকার ভেতরেই সেগুলো কেনাবেচা হবে। নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সরকারি সহায়তা থাকবে।
করোনা আক্রান্তের ক্ষেত্রে কী হবে: লকডাউন এলাকার কেউ করোনা আক্রান্ত হলে বাসায় আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হবে। সরকারিভাবে তাদের মনিটরিং চলবে। আত্মীয়স্বজনের গতিবিধি খেয়াল রেখে তাদের পরামর্শ দেবেন সংশ্লিষ্টরা। রোগীর শারীরিক অবস্থা বেশি নাজুক হলে তাকে এলাকার বাইরে আনা হবে।
কেন এই সিদ্ধান্ত: করোনায় প্রতিদিন মৃত্যু সংখ্যা গড়ে ৩০ জনের কাছাকাছি থাকায় নতুন এই পদ্ধতি চলতি সপ্তাহেই শুরু হতে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রথমে ঢাকায় পরীক্ষামূলকভাবে এটি করা হলেও পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। এরপর সরকার ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। দীর্ঘ ৬৬ দিনের এই ছুটিতে লকডাউন ব্যবস্থা না থাকায় সংক্রমণ বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এরপরই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে জোন ভাগ করে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে রাজধানী ঢাকায় সর্বাধিক করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে রাজধানী ঢাকার কোনো থানাকে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি। তবে ৩৮টি থানাকে আংশিক লকডাউন ঘোষণা বা ইয়েলো জোনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে ১১টি থানাকে লকডাউন নয় বা গ্রিন জোনে দেখানো হয়েছে। গতকাল রোববার করোনা ইনফো ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য জানা গেছে। রাজধানীর ইয়েলো জোন: আদাবর, থানা, উত্তরা পূর্ব, উত্তরা পশ্চিম, ওয়ারী, কদমতলী, কলাবাগান, কাফরুল, কামরাঙ্গীরচর, কোতোয়ালি, খিলক্ষেত, গুলশান, গে-ারিয়া, চকবাজার, ডেমরা, তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, দক্ষিণখান, দারুসসালাম, ধানম-ি, নিউমার্কেট, পল্টন মডেল, পল্লবী, বংশাল, বাড্ডা, বিমানবন্দর, ভাটারা, মিরপুর মডেল, মুগদা, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, রমনা মডেল, লালবাগ, শাহআলী, শাহজাহানপুর, শেরে বাংলানগর, সবুজবাগ, সূত্রাপুর ও হাজারীবাগ থানা এলাকা। গ্রিন জোন: উত্তরখান থানা, ক্যান্টনমেন্ট থানা, খিলগাঁও, তুরাগ, বনানী, ভাষানটেক, মতিঝিল, রামপুরা, রূপনগর, শাহবাগ ও শ্যামপুর থানা এলাকা।
অপরদিকে রেড জোনের আওতায় দেশের অর্ধশত জেলা। গত রোববার সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ওয়েবসাইট (করোনা ইনফো) থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে দেশের তিনটি বিভাগসহ ৫০টি জেলা ও ৪০০ উপজেলাকে রেড জোন বা পুরোপুরি লকডাউন দেখানো হচ্ছে। ইয়েলো জোন বা আংশিক লকডাউন দেখানো হচ্ছে পাঁচটি বিভাগ, ১৩টি জেলা ও ১৯টি উপজেলাকে। আর গ্রিন জোন বা লকডাউন নয়, দেখানো হচ্ছে একটি জেলা এবং ৭৫টি উপজেলাকে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে: এ বিভাগের গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও টাঙ্গাইলকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ বিভাগে শুধু ঢাকা ও ফরিদপুরকে আংশিক লকডাউন বলা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগে: এ বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কুমিল্লা, কঙ্বাজার, ফেনী, খাগড়াছড়ি, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ বিভাগের বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটিকে আংশিক লকডাউন বলা হয়েছে। সিলেট বিভাগে: এ বিভাগের সব জেলা অর্থাৎ- হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও সিলেটকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। ময়মনসিংহ বিভাগে: এ বিভাগের সবকটি জেলাকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ জেলাগুলো হলো- জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুর। বরিশাল বিভাগে: এ বিভাগের মধ্যে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। বরিশাল বিভাগের ভোলা ও ঝালকাঠিকে আংশিক লকডাউন বলা হয়েছে। খুলনা বিভাগে: এ বিভাগের চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা, মেহেরপুর, নড়াইল ও সাতক্ষীরাকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ বিভাগের বাগেরহাট, কুষ্টিয়া ও মাগুরাকে আংশিক লকডাউন বলা হচ্ছে। খুলনা বিভাগেই দেশের একমাত্র গ্রিন জোন বা বা লকডাউন নয় এমন হিসেবে ঝিনাইদহকে চিহ্নিত করা হয়েছে। রংপুর বিভাগে: এ বিভাগের সব জেলাকেই পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। জেলাগুলো হলো- দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও। রাজশাহী বিভাগে: এ বিভাগের বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহীকে মধ্যে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জকে আংশিক লকডাউন বলা হচ্ছে।